পরমহংস যোগানন্দ, তাঁর অটোবায়োগ্রাফি অফ এ য়োগি (যোগী কথামৃত) পুস্তকে লিখছেন, “ভারতের অর্জিত জ্ঞানভাণ্ডার সমগ্র মানব সমাজের নিকট অগ্রজসম এক ঐতিহ্য।”
ওই জ্ঞানের উত্তরাধিকারী এক মুখ্য চরিত্র — ধর্মসংস্থাপক ও অবতার ভগবান কৃষ্ণ, যোগবিজ্ঞান ও আত্মার মুক্তি সাধনে সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবদগীতায় যাঁর শাশ্বত শিক্ষা সর্বকালের জন্য অনুবদ্ধ রয়েছে।
পরমহংসজি উল্লেখ করেছেন, “কৃষ্ণ শুধুমাত্র ধর্মগুরু ছিলেন না, সাধুত্বের পরীক্ষার জন্য তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল রাজকীয় দায়দায়িত্ব। একজন রাজা হয়েও অনাসক্তিতে তিনি ছিলেন সর্বাধিক সফল এক মানুষ।”
শ্রীকৃষ্ণের জন্মবার্ষিকী (হিন্দু চান্দ্র পঞ্জিকা অনুযায়ী বর্তমান বৎসরে ২৬শে আগস্ট) পূর্ণ মর্যাদায় উদযাপন করতে, আশা করি, আপনারা এই মাসের সংবাদ সংকলনে দেওয়া উৎসাহব্যঞ্জক বার্তা পড়ে এবং মানবজীবনে শ্রীকৃষ্ণের সম্যক জীবনযাপনের চিরন্তন দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নিজ অন্তর্নিহিত দিব্যতার উপলব্ধিতে উদ্দীপ্ত হবেন।
পরমহংস যোগানন্দের আলোচনা ও লেখা থেকে:
আমাদের উদ্বেগময় আধুনিক ব্যস্ত জীবনে ভগবদগীতায় নিহিত কৃষ্ণের বার্তা যেন যথোপযুক্ত সর্বোত্তম মতবাদ।
পৃথিবীর ব্যস্ত মানুষ বা অধ্যাত্মতত্ত্বের উচ্চাভিলাষী, উভয়ের জন্যেই ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত পথটি হল পরিমিত, মধ্য, এক স্বর্ণালী পথ।
শুষ্ক বুদ্ধিজীবীগণ, যারা অন্ধ বিশ্বাসীদের চিত্ত বিনোদনের জন্য ধর্মের মতবাদ নিয়ে যুক্তিহীন মানসচর্চা করে, গীতা-জ্ঞান তাদের জন্য নয়; এই পৃথিবীর স্ত্রী বা পুরুষ, গৃহস্থী বা ত্যাগী, সকল মানুষকে গীতা শিক্ষা দেয়, কিভাবে ধাপে-ধাপে যোগাভ্যাস করে সুষম জীবনযাপনের মাধ্যমে যথার্থ ঈশ্বর-সংযোগ ঘটে।
গীতার অধ্যায় ৪:২৯ এবং ৫:২৭-২৮ শ্লোকে উল্লিখিত ক্রিয়াযোগ প্রক্রিয়া, যা শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শিখিয়েছিলেন, তা যোগধ্যানের সর্বোত্তম অধ্যাত্ম-জ্ঞান। জড়বাদী যুগে গুপ্ত থাকা এই অবিনাশী যোগ, আধুনিক মানবজাতির জন্যে মহাবতার বাবাজি পুনরুজ্জীবিত করেন; এবং যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া/সেল্ফ-রিয়লাইজেশন ফেলোশিপের গুরুগণের মাধ্যমে তা শিক্ষা দেওয়া হয়।
শ্রীকৃষ্ণকে বিশেষ ভাবে আমরা ভগবদগীতায় পাই, অর্জুনের গুরু এবং পরামর্শদাতা রূপে, আর পৃথিবীতে মহিমাময় যোগবার্তার উপদেষ্টা — ঈশ্বর সংযোগ এবং মুক্তিলাভের সঠিক কর্মপদ্ধতি ও ধ্যানের পথপ্রদর্শক। এই জ্ঞান তাঁকে ভক্তের মনে ও হৃদয় সিংহাসনে যুগ যুগ ধরে অধিষ্ঠিত করে রেখেছে।
কৃষ্ণের জীবনদর্শন প্রমাণ করে যে, পার্থিব দায়-দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ভগবান আমাদের যেখানে রেখেছেন,সেখানে তাঁকে আনাই সমস্যা সমাধানের উপায়। আমাদের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, মনোরাজ্যে ঈশ্বর সংযোগ বিরাজ করলে, স্বর্গকে অবশ্যই আসতে হবে।
সংসার বৈরাগ্য অথবা জড়জীবনে পার্থিব সমস্যায় জর্জরিত হওয়া, এই দুই চরম বিপত্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে নিরন্তর সাধনার মাধ্যমে মনকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, যাতে অন্তরে সদা ভগবৎ চৈতন্যে সজাগ থেকে মানুষ তার নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় দায়িত্বসকল সঠিকভাবে পালন করতে পারে। কৃষ্ণের জীবনই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ভগবদগীতায় বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের বাণী, আধুনিক যুগ ও সর্বযুগের যথাযথ সমাধান: দায়িত্বের সঙ্গে কর্ম-যোগ পালন, অনাসক্তি এবং ঈশ্বর উপলব্ধির জন্য ধ্যান। অন্তরে ঐশ্বরিক শান্তি ব্যতীত কাজকরা নরক তুল্য; আবার হৃদয়-উদ্বেলিত দিব্য আনন্দে ভরপুর হয়ে কাজ করা যেন সুবহ এক স্বর্গের উপস্থিতি।
ভগবদগীতা, গড টকস উইথ অর্জুন, ওপর পরমহংস যোগানন্দজির যুগান্তকারী অনুবাদ ও টীকা ভাষ্য পড়তে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। পরমহংসজি বলেছেন, “মহাবিশ্বের সমগ্র জ্ঞান গীতায় পুঞ্জীভূত রয়েছে। নিগুঢ় জ্ঞানভাণ্ডার উদ্ঘাটনকারী প্রাঞ্জল ভাষায়…গীতা সকল স্তরের উদ্যোগী মানুষের ও অধ্যাত্ম পিপাসুদের দ্বারা বোধগম্য এবং প্রযুক্ত হয়েছে।”