শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দের লেখনী থেকে উদ্ধৃত
ইতিবাচক মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি
তুমি যদি সুখী হওয়ার আশা একেবারে ছেড়ে দিয়ে থাকো, আশান্বিত হও। কখনও আশাহত হবে না। তোমার আত্মা, যা চিরআনন্দময় পরমাত্মারই প্রতিবিম্ব, প্রকৃতপক্ষে নিজেই আনন্দস্বরূপ।
সুখ বাহ্য অবস্থার ওপর কিছুটা নির্ভরশীল হলেও প্রধানত মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে।
মূলত, পরিস্থিতি ভালো বা মন্দ হয় না; তারা সর্বদাই নিরপেক্ষ, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মনের বিমর্ষ বা প্রফুল্ল মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আপাতদৃষ্টিতে হতাশাজনক বা উৎসাহজনক বলে মনে হয়।
যদি নিজের পরিস্থিতির পরিবর্তন চাও তবে নিজের চিন্তাধারার পরিবর্তন করো। তোমার চিন্তাভাবনার জন্য যেহেতু তুমি একাই দায়ী, তাই একমাত্র তুমিই তা বদলাতে পারো। প্রতিটি চিন্তা তার প্রকৃতি অনুযায়ী সৃষ্টি করে থাকে তা উপলব্ধি করলে তুমি নিজেই তোমার চিন্তার পরিবর্তন করতে চাইবে। মনে রেখো এই নিয়মটি সবসময় কাজ করে, এবং তুমি স্বভাবগত ভাবে যে ধরণের চিন্তাভাবনা পোষণ করে থাকো তা তুমি সর্বদাই প্রদর্শন করে যাচ্ছ। অতএব এখন থেকে শুধু এমন চিন্তাভাবনাই করো যা তোমার কাছে সুস্বাস্থ্য ও সুখ নিয়ে আসবে।
মনই সমস্ত জীবন্ত কোশের মস্তিষ্ক, আবেগ এবং অনুভূতি, তাই মন মানুষের শরীরকে সজাগ বা অবসাদগ্রস্ত করে রাখতে পারে। মনই হচ্ছে রাজা, এবং তার প্রজা কোশগণ ঠিক তাদের রাজকীয় প্রভুর মেজাজ অনুযায়ী আচরণ করে। যেমন আমরা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার পুষ্টিকারিতার দিকে খেয়াল রাখি, তেমনই রোজ আমাদের মনকে আমরা যে মানসিক খাদ্য পরিবেশন করি, তার পুষ্টিকারিতার কথাও বিবেচনা করা উচিত।
তোমরা দিনরাত দুঃখ দুঃখ করো, তাই দুঃখ আছে। মনে মনে দুঃখকে অস্বীকার করো, দুঃখ আর থাকবে না। স্বয়ং এর এই ঘোষণাকেই আমি মানুষের অন্তঃস্থ বীরপুরুষ বলি। এটি তার দিব্য বা প্রকৃত স্বরূপ। দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষকে তার দৈনন্দিন সমস্ত কাজে এই বীর সত্তাকে অভিব্যক্ত করতে হবে।
যদি তুমি সুখী হতে না চাও তাহলে কেউ তোমায় সুখী করতে পারবে না। এর জন্য ভগবানকে দোষ দিও না। আর যদি তুমি সুখী হতে চাও তাহলে কেউ তোমায় অসুখী করতে পারবে না। যদি তিনি আমাদের নিজেদের ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করার স্বাধীনতা না দিতেন তাহলে আমরা অসুখী হলে তাঁকে দোষ দিতে পারতাম, কিন্তু সেই স্বাধীনতা তিনি আমাদের দিয়েছেন। আমাদের জীবন কেমন হবে আমরা নিজেরাই ঠিক করি।
দৃঢ় চরিত্রের মানুষেরা সাধারণত সবচেয়ে সুখী। যে সমস্যা তাদের নিজেদের কর্মের বা বোঝার ভুলে উৎপন্ন হয়েছে তার জন্য তারা অপরকে দোষারোপ করে না। তারা জানে যে তাদের সুখ বাড়াবার বা কমাবার শক্তি অন্য কারও নেই, যদি না তারা এমন দুর্বল হয় যে অপরের প্রতিকূল চিন্তাধারা এবং দুষ্কর্মের প্রভাব তারা নিজেদের ওপর পড়তে দেয়।
সর্বদা শিক্ষার আগ্রহ এবং সঠিক আচরণের জন্য সদাপ্রস্তুত থাকার মধ্যেই তোমার সর্বোচ্চ সুখ নিহিত আছে। তুমি নিজেকে যত উন্নত করবে ততই তোমার চারিপাশের লোকেদেরও উন্নত করবে। যে মানুষ নিজেকে উন্নত করতে থাকে তার সুখ ক্রমশই বৃদ্ধি পায়। তুমি যত বেশি সুখী হবে তোমার আশেপাশের মানুষেরাও ততই বেশি সুখী হবে।
জীবনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করো। যখন আমাদের চারিদিকে সৌন্দর্য ছড়ানো তখন নর্দমার দিকে কেন তাকানো? কলা, সঙ্গীত এবং সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলির মধ্যেও হয়ত কিছু খুঁত পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের মাধুর্য এবং বৈশিষ্ট্য উপভোগ করাই কি বেশি ভালো নয়?
আমরা প্রায় সবাই সেই “খারাপ কিছু দেখো না, খারাপ কিছু শুনো না, খারাপ কিছু বোলো না” প্রবচনটির প্রতীক সেই তিনটি ছোটো বানর মূর্তির সঙ্গে পরিচিত আছি। আমি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর দিই:“যা ভালো তাই দেখো, যা ভালো তাই শোনো, যা ভালো তাই বলো।”
নেতিবাচক মনোভাব থেকে মুক্তি
আত্মার স্বভাবসিদ্ধ চিরনূতন ঐশ্বরিক আনন্দ অবিনাশী। একই ভাবে মনের মধ্যে তার প্রকাশও কখনও বিনষ্ট করা যায় না যদি কেউ এটিকে ধরে রাখতে জানে, এবং বিষণ্ণতার ভাব পোষণ করে স্বেচ্ছায় মনে পরিবর্তন না নিয়ে আসে আর দুঃখী না হয়ে পড়ে।
তুমি ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি; তোমার আচরণ দেবতার মতো হওয়া উচিত। কিন্তু কি হয়? সকালে প্রথমেই তোমার মেজাজ গরম হয় আর অভিযোগ করো “আমার কফি ঠান্ডা!” কি এসে যায়? এইসবে কেন বিচলিত হওয়া? মনে সেই সমভাব রাখো, যেখানে তুমি সম্পূর্ণ শান্ত, সমস্ত ক্রোধ থেকে মুক্ত। সেটাই তোমার কাম্য। কারোকে বা কোনো কিছুকে তোমার শান্তি ভঙ্গ করতে দিও না। তোমার শান্তিই তোমার সম্পদ। কোনো কিছুকেই তা হরণ করতে দিও না।
জীবনের ক্ষুদ্রতা থেকে, যে ছোটো ছোটো বিষয় তোমার শান্তিভঙ্গ করছে তার থেকে, নিজেকে উদ্ধার করো।
কেউই দুঃখ পছন্দ করে না। পরের বার যখন মন বিষণ্ণ হবে তখন নিজের মনকে বিশ্লেষণ করো না কেন? দেখবে যে তুমি কেমনভাবে স্বেচ্ছায়, ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে দুঃখী করে তুলছো। আর তুমি যখন এমনটি করো, তোমার চারিপাশের সকলে তোমার মনের নিরানন্দ অবস্থা অনুভব করতে পারে।
তুমি তোমার সাময়িক মানসিক বিষণ্ণতা জয় করতে পারো, তা যত ভয়ানকই মনে হোক না কেন। মনে মনে নিশ্চয় করো যে তুমি আর কখনও সাময়িক মানসিক বিষণ্ণতার শিকার হবে না। আর যদি তোমার মনমরা ভাবের আবার উদয় হয় তাহলে তা কোথা থেকে এলো তার বিশ্লেষণ করো এবং কোনো নির্দিষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ নাও।
মনে রেখো যে তুমি যখন অসুখী হও, সেটা সাধারণত এই জন্য যে তুমি জীবনে যে সমস্ত বড়ো কাজ নিশ্চিতভাবে সম্পন্ন করতে চাও তা মনেপ্রাণে কল্পনা করো না। আর তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তোমার ইচ্ছাশক্তি, তোমার সৃজনশীলতা, এবং তোমার ধৈর্যকেও তুমি যথেষ্ট দৃঢ়তার সঙ্গে কাজে লাগাও না।
নিজের উন্নতি এবং অন্যের উপকারের জন্য গঠনমূলক কাজে ব্যস্ত থাকো, কারণ যে ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করবে তাকে অপরের ভালোর জন্যও রোজ চেষ্টা করতে হবে। তুমি যদি এই আদর্শ অনুসরণ করো, তাহলে তুমি মানসিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়ার বিষাদ-অপনোদনকারী আনন্দ অনুভব করবে।
পরসেবা
অপরকে সুখী করাতেই সুখ, নিজের স্বার্থচিন্তা ছেড়ে অন্যকে আনন্দ দেওয়াতেই সুখ।
আমাদের নিজেদের আনন্দের জন্য অপরকে আনন্দ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং অত্যন্ত সন্তোষদায়ী। কিছু লোক শুধু তাদের নিজেদের পরিবারের কথাই ভাবে:“আমরা চার, কেউ না আর।” অন্যরা শুধু নিজের কথাই ভাবে:“কি ভাবে আমি সুখী হব?” কিন্তু ঠিক এই লোকগুলোই সুখী হয় না!
নিজের জন্য বাঁচাই সমস্ত দুঃখের কারণ।
অপরের আধ্যাত্মিক, মানসিক এবং পার্থিব সহায়তা করলে দেখবে যে তোমার নিজের প্রয়োজনগুলোই মিটে যাচ্ছে। যখন অপরের সেবায় নিজেকে ভুলে যাবে, দেখবে তোমার সুখের পেয়ালা না চাইতেই পূর্ণ হয়ে যাবে।
যখন তুমি এই পৃথিবীতে এসেছিলে, তুমি কেঁদেছিলে আর অন্যরা হেসেছিল। নিজের জীবন এমনভাবে কাটাও যাতে যখন তুমি যাবে, অন্যরা কাঁদবে কিন্তু তুমি হাসবে।
সুখের অভ্যন্তরীণ পূর্বশর্ত
যত গভীরভাবে ধ্যান করবে এবং যত উৎসাহের সঙ্গে সেবা করবে, তত বেশি আনন্দে থাকবে।
ধ্যান করে এবং সদাবিদ্যমান, সদাচৈতন্যময়, চিরনূতন আনন্দের, তথা ভগবানের সঙ্গে নিজের চেতনাকে সমন্বয়বদ্ধ করে আনন্দে থাকার সমস্ত অভ্যন্তরীণ পূর্বশর্ত নিজের ভেতর বহন করতে শেখো। বাইরের কোনো অবস্থার ওপর যেন তোমার সুখ কখনও নির্ভর না করে। তোমার পরিবেশ যাই হোক না কেন, তাকে তোমার অন্তরের শান্তিকে স্পর্শ করতে দিও না।
প্রকৃত আনন্দ বাইরের অভিজ্ঞতার সমস্ত পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে। যখন তুমি নিজের প্রতি অন্যের অন্যায়ের ক্রুশবিদ্ধ হয়েও প্রেম এবং ক্ষমা দিতে পারবে, এবং যখন বাইরের পরিস্থিতির সমস্ত বেদনাদায়ক চাপ সত্ত্বেও নিজের ভিতরের সেই দিব্য শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে, তখন তুমি এই আনন্দকে জানতে পারবে।
প্রতি রাতে শোবার আগে এবং সকালে দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করার আগে অন্তত আধঘণ্টার জন্য, সম্ভব হলে আরও বেশি সময়ের জন্য, [ধ্যানে] নীরব ও শান্ত থাকো। এতে অভ্যন্তরীণ আনন্দের এক অদম্য, অটুট অভ্যাস তৈরি হবে যা তোমাকে দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের সমস্ত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে সক্ষম করবে। সেই অপরিবর্তনীয় আনন্দ অন্তরে নিয়ে তোমার দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের চেষ্টা করো।
যতই তুমি আনন্দের জন্য বাইরের অবস্থার ওপর নির্ভর করবে, ততই তুমি কম আনন্দ অনুভব করবে।
যদি তুমি মনে করো যে তুমি ঈশ্বরকে ভুলে আনন্দে জীবন কাটিয়ে দেবে, তাহলে ভুল করছ, কারণ যতক্ষণ না তুমি বুঝতে পারছ যে ব্রহ্মাণ্ডে ঈশ্বরই একমাত্র সত্য ততক্ষণ তুমি নিঃসঙ্গতায় বারবার আর্তনাদ করে উঠবে। তুমি তাঁরই প্রতিকৃতিতে সৃষ্ট। তুমি কোনো কিছুতেই স্থায়ী আনন্দ খুঁজে পাবে না, কারণ ঈশ্বর ছাড়া কিছুই সম্পূর্ণ নয়।
ঈশ্বরের সাথে ভাব বিনিময় করে আমি যে নিখাদ সুখ পাই কোনো ভাষায় তা বর্ণনা করা যায় না। দিনরাত আমি আনন্দে ডুবে থাকি। সেই আনন্দই ঈশ্বর। তাঁকে জানার অর্থই হল তোমার সকল দুঃখের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা। তিনি তোমাকে উদাসীন এবং বিষণ্ণ দেখতে চান না। এটি ঈশ্বর সম্বন্ধে সঠিক ধারণা নয়, আর তাঁকে প্রসন্ন করার পথও নয়। আনন্দে না থাকলে তুমি তাঁর সন্ধান পর্যন্ত পাবে না। তুমি যত বেশি আনন্দে থাকবে, ততই তাঁর সঙ্গে তোমার মেলবন্ধন থাকবে। যারা তাঁকে জানে, তারা সর্বদাই আনন্দে থাকে, কারণ ঈশ্বর আনন্দস্বরূপ।
সংকল্পবাক্য
সংকল্পবাক্যের তত্ত্ব এবং নির্দেশাবলি
আজ ভোরবেলা থেকে যত মানুষের সঙ্গে দেখা হবে, তাদের সকলের মধ্যে আমি আমার আনন্দ ছড়িয়ে দেবো। যারাই আজ আমার পথে পড়বে, তাদের জন্য আমি খুশীর আলো হব।
আমি সর্বত্র ভালো দেখে, এবং জগতকে ঈশ্বরের ত্রুটিহীন কল্পনার প্রকাশ রূপে দেখে, নতুন ভাবে চিন্তা করার অভ্যাস তৈরি করি।
আমি আজ যেখানে আছি, সেখানে এই মুহূর্তে, খুশী থাকতে মনস্থির করব।